একটি স্বচ্ছ ও স্বাধীন নির্বাচন প্রক্রিয়া, একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ, শক্তিশালী বিরোধী দলের প্রতিবাদমুখর একটি পার্লামেন্ট, তুলনামূলক স্বাধীন গণমাধ্যম এবং রাজনীতি থেকে দূরে থাকা একটি সেনাবাহিনী—এই সব মিলিয়েই ভারত। ১৯৫০ সালে ভারত তার সংবিধান পরিগ্রহণ করার পর থেকে এমনটাই সবাই জেনে এসেছে। উন্নয়নশীল বিশ্বে ভারত সেই গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে এত দিন দাঁড়িয়ে ছিল, যেখানে নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগের কার্য পরিচালনার মূল ভিত্তি হলো সংবিধান। কিন্তু সেই অর্জন যে কতটা ভঙ্গুর, সংবিধানের ওপর মানুষের আস্থা বিলীন হওয়ার পরিস্থিতি যে কতটা সন্নিকটবর্তী, তা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টির সরকার মাত্র চার বছরেই ভারতবাসীকে বুঝিয়ে দিয়েছে।
ভারতে খুব সুন্দরভাবে বিকেন্দ্রীকৃত একটি প্রশাসনিক কাঠামো রয়েছে। এই কাঠামো অনুযায়ী একেকটি রাজ্যে জনগণের ভোটে নির্বাচিত যে দল বা জোট রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন অর্জন করে, সেই দল বা জোটের নেতা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে রাজ্য শাসন করেন। এর পাশাপাশি প্রতিটি রাজ্যে একজন করে রাজ্যপাল বা গভর্নর থাকেন। কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়োগ দেওয়া এটি একটি আনুষ্ঠানিক, নিরপেক্ষ ও সাংবিধানিক পদ। রাজ্যসভার নির্বাচনের পর সবচেয়ে বেশি আসন জেতা দল বা জোটকে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানান রাজ্যপাল।
সাংবিধানিকভাবে নিরপেক্ষ পদ বলা হলেও এই পদকে প্রায় প্রতিটি সরকারই নিজ স্বার্থে ব্যবহারের চেষ্টা করেছে। দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটকে গত মাসেই এ ধরনের একটি চেষ্টা রাজ্যপালের কার্যালয়ের নিরপেক্ষতাকে স্পষ্টতই ক্ষুণ্ন করেছে। সেখানে বিজেপিবিরোধী জোট বেশি আসন জিতেছে। সেখানকার রাজ্যপাল (যিনি মোদির পুরোনো সহযোদ্ধা ছিলেন) বজুভাই ভালা বিজেপিবিরোধী জোটকে সরকার গঠনে আমন্ত্রণ জানাতে বাধ্য ছিলেন। কিন্তু তিনি তা না করে মোদির প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে কম আসন পাওয়া বিজেপিকে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানিয়ে বসলেন। গণতন্ত্রের মৌলিক ভিত্তি টিকিয়ে রাখার স্বার্থে শেষ পর্যন্ত ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করা জোটকে দিয়ে সরকার গঠনের আদেশ দেন। এরপর বিরোধী জোট সরকার গঠনের সুযোগ পায়।
পার্লামেন্টেও ঠিক একই ধরনের ‘ক্ষয়’ দেখা যাচ্ছে। কয়েক দশক ধরে বিরোধী দলের জন্য সরকারের সমালোচনার ভেন্যু হিসেবে পার্লামেন্ট ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মাস কয়েক আগে বিরোধী নেতারা বেশ কয়েকবার সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট আহ্বানের চেষ্টা করেছেন। পার্লামেন্টের অন্য সব কাজের তুলনায় অনাস্থা ভোটের প্রস্তাবকে সব সময় অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। কিন্তু লোকসভার বিজেপি মনোনীত স্পিকার এক মাসের বেশি সময় ধরে বিরোধী নেতাদের অনাস্থা ভোটের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে যাচ্ছেন। পার্লামেন্টে বিজেপির জোরালো সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে এবং তার জন্য অনাস্থা ভোটের প্রস্তাব কোনো হুমকিও নয়। শুধু অধিবেশন চলাকালে জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যমে যখন বিরোধী নেতাদের মোদির অর্থনৈতিক কৌশলের ভুলত্রুটি তুলে ধরতে দেখা যায়, তখন সরকার একটু অস্বস্তিতে পড়ে।
ভারতের বার্ষিক বাজেটে যদিও দেশটির অর্থনীতির পুরো নয়, বরং অংশবিশেষ জনগণের সামনে আসে, তথাপি এই বাজেটের একটি বিশাল প্রভাব আছে। বাজেট প্রস্তাবের পর আইনপ্রণেতারা কয়েক সপ্তাহ ধরে স্বাস্থ্য, শিক্ষা বা এই ধরনের নানা খাতের বরাদ্দ নিয়ে আলোচনা করেন। যদি দেখা যায়, বাজেট অধিবেশন শেষ হয়ে যাচ্ছে এবং কিছু বরাদ্দ এখনো অনুমোদন করতে বাকি থেকে যাচ্ছে, তাহলে পাস না হওয়া সব বরাদ্দকে একীভূত করে সেগুলো অনুমোদন করা হবে কি হবে না, তা ঠিক করতে ভোট নেওয়া হয়। এই ভোট প্রক্রিয়াকে ‘গিলোটিন’ বলে। গত মার্চে, বাজেট অধিবেশন শেষ হওয়ার সপ্তাহ তিনেক আগে আইনপ্রণেতারা ‘গিলোটিন’ আহ্বান করে বিভিন্ন খাতের বরাদ্দ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করতে চান। কিন্তু মোদির দল সেই সমালোচনার মুখে পড়তে চায়নি বলে বিরোধীদের সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করে।
মোদি সরকার স্বাধীন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজের আজ্ঞাবহ করার যে অভিলাষ চরিতার্থ করছে, তার ছোঁয়া সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে। সেখানে প্রধান বিচারপতির ঠিক করে দেওয়া বিচারপতিরা নির্দিষ্ট বিষয়ে রায় দিচ্ছেন। গত জানুয়ারিতে চারজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি প্রায় নজিরবিহীন একটি সংবাদ সম্মেলন করেছেন। সেখানে তাঁরা প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে রায় প্রভাবিত করতে নির্দিষ্ট বিচারকদের নির্দিষ্ট মামলার বিচার করতে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন।
ভারতের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবী ও মোদি সরকারের কড়া সমালোচক প্রশান্ত ভূষণ এই অভিযোগের প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা ব্যাখ্যা করেছেন। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক স্পর্শকাতর মামলাগুলো বেছে বেছে এমন বেঞ্চে দেওয়া হচ্ছে, যেখানে কোনো জ্যেষ্ঠ বিচারপতি নেই। সরকারের পক্ষে যাতে রায় যায়, সে জন্যই এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, প্রধান বিচারপতি পরিষ্কারভাবে সরকারের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য বিচার বিভাগকে ব্যবহার করছেন। প্রশান্ত ভূষণের অভিযোগ, সরকার ও ক্ষমতাসীন দল প্রধান বিচারপতিকে ঘুষের মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে একের পর এক ব্ল্যাকমেল করে যাচ্ছে।
মোদি সরকার ভারতের যেসব প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তিতে ক্ষয় ধরানো শুরু করেছে, তাদের মধ্য থেকে সেনাবাহিনীও বাদ পড়েনি। ভারতে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে সেনাপ্রধান নিয়োগ করার রেওয়াজ বহুদিনের। সেই রেওয়াজ ভেঙে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে জেনারেল বিপিন রাওয়াতকে এই সরকার সেনাপ্রধান করেছে। সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে বিপিন রাওয়াত যেভাবে মোদি সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে যাচ্ছেন, যা ভারতের আগের কোনো সেনাপ্রধানের ক্ষেত্রে কখনোই দেখা যায়নি।
এমনকি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যে নির্বাচন কমিশন এত দিন সবার শ্রদ্ধার জায়গা ছিল, তার বিরুদ্ধেও মোদির স্বার্থ রক্ষার্থে ভোটের তারিখ এগোনো-পেছানোর অভিযোগ উঠেছে। এটি মোটেও এখন আর চমকানোর মতো খবর নয় যে মোদির গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে এক সহযোগী সরকারি আমলা গত বছর পর্যন্ত ভারতের প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই মুহূর্তে ভারতের হাতে গোনা দু-একটি ছাড়া সব সংবাদমাধ্যম মোদি আর তাঁর রাজনীতির ‘চিয়ারলিডারে’ পরিণত হয়েছে। তারা সরকারের সমালোচনামূলক রিপোর্টিং শুধু এড়িয়েই যায় না, বরং সরকারের পক্ষে ইনিয়ে-বিনিয়ে রিপোর্ট করতে থাকে। সমাজের একটি বিরাট অংশ মোদির এই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির পক্ষে হাততালি দিচ্ছে।
সংবাদমাধ্যমের মান কোথায় নেমেছে, তা সম্প্রতি কোবরাপোস্ট ওয়েবসাইটের স্টিং অপারেশন থেকেই বোঝা যাচ্ছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদী গ্রুপের প্রতিনিধি সেজে ওই ওয়েবসাইটের লোকজন ভারতের বড় বড় গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীদের সঙ্গে দেখা করেন। ছদ্মবেশী লোকেরা আসন্ন নির্বাচনে যাতে বিজেপি উপকৃত হয়, সে জন্য হিন্দু জাতীয়তাবাদের পক্ষে প্রচারণা চালানোর জন্য গণমাধ্যমগুলোকে প্রস্তাব দেন এবং বিনিময়ে তাদের লাখ লাখ ডলার দেওয়ার প্রস্তাব দেন। বেশির ভাগ গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান টাকার বিনিময়ে এই কাজ করার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়।
এখন ভারত যখন আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, ঠিক সেই সময় মোদির জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করেছে। এখন একটি আশঙ্কা সবার মনে দেখা দিচ্ছে, সেটি হলো ব্যাপক জনপ্রিয় থাকা অবস্থায় মোদি যদি এভাবে জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করতে পারেন, তাহলে তাঁর দলের জনপ্রিয়তা যখন আরও কমে যাবে এবং সেই অবস্থায় তাঁকে যখন নির্বাচনে জিতে আসতে হবে, তখন দলকে জেতানোর জন্য তিনি কী পর্যায়ের অগণতান্ত্রিক আচরণ করবেন?